Sheikh Mujibur Rahman

১৫ আগস্ট : কাঁটাতারের এপার ওপার

তারিখ সেই ১৫ আগস্ট, সালের শুধু ফারাক। এপার বাংলায় যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কুচকাওয়াজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপনের মাধ্যমে স্বাধীনতার বিজয় ধ্বজা উড়ছে, ওপারে তখন গভীর শোক ও শ্রদ্ধাভারে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনিমিত করে রাখার মাধ্যমে  “জাতীয়  শোক দিবস” পালন হচ্ছে। বৃটিশ শাসনের অবসানকালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা রুখতেই মূলত ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে অখন্ড বাংলাদেশের বিভক্তের হেতু ছিল ধর্ম; শুধুমাত্র  ধর্মের কারণে পৃথক হয়ে গিয়েছিল আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সেই সময়ে আবুল ফজলের  লেখা “মানবতন্ত্র” প্রবন্ধে এর খাসা প্রতিফলন ঘটেছিল,

“ ধর্ম আর সিক্যুলারিজম আজ স্রেফ মুখের বুলিতে পর্যবসিত। ধার্মিক না হয়েও ধর্মের নামে গদগদ হওয়া আর মনে সিক্যুলার না হয়েও সিক্যুলারিজমের নামে মুক্তকচ্ছ হওয়া তেমন কোনো বিরল দৃশ্য নয়।… রাজনীতিবিদের মুখে এখন ধর্মের যত বুলি শোনা যায়, স্বয়ং ধর্ম প্রবর্তকদের মুখেও কোনো দিন তত ধর্ম বুলি শোনা যায় নি।…এখন ধর্ম আর সিক্যুলারিজমের উপর জোর দিতে গিয়ে আমরা সাধারণ মানবতাকে শুধু খাটো নয় প্রায় মুছে ফেলেছি।….”

এই সময়ে  রাজনীতিবিদেরা আর কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ ধর্মের জাত বিজাত বিশ্লেষণে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন; আর তাদের সেই ধ্যানের মগ্নতার চরম পরিণতি স্বরূপ আজও বাঙালিদের এপার বাংলা -ওপার বাংলা করে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থবুদ্ধি বাঙালিদের তিলতিল করে অর্জিত সৃষ্ট সাহিত্য সংস্কৃতির মোড়কই পাল্টে দিয়েছিলো সেদিন। ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন পাকিস্তানের অভ্যুত্থান ঘটেছিলো এবং ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতের উন্মেষ ঘটেছিলো। যেহেতু, মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছিলো এজন্য পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটো পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান  এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। এই বিভাজন  পূর্ব বাংলার অবস্থার কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।  কারণ, এর পূর্বে শাসকগোষ্ঠী ছিলো ব্রিটিশ; যাদের ভাষার প্রকাশ মাধ্যম ছিলো ইংরেজি। এরপর ধর্মীয় অনুশাসন কিংবা বলা যায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যাদের আগমন ঘটলো, তাদের ভাষা উর্দু। সূক্ষ বিচার-বিশ্লেষণবোধ কি বলে? শাসকের প্রতিনিধি যারা তাদের ভাষার সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের ভাষার ভিন্নতা থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই তো শাসক গোষ্ঠীর দূরত্ব তৈরি হবে। বাঙালিদের সঙ্গে অবাঙালি পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি, আচার–আচরণ, কথাবার্তা এবং সর্বোপরি মানসিকতার ছিলো বিরাট ব্যবধান এবং দুটো অংশের ভৌগোলিক ব্যবধান ছিলো ১২শ মাইলের। এসব ব্যবধানের কারণে তাদের বিজাতীয় ক্রোধ দিনদিন তীব্রতর হয়ে উঠে ছিলো। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছিল বারবার। তার প্রথম সূত্রপাত বলা যায়, একুশের ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ -১৯৭১ এই সময় পর্বের ইতিহাস ঘাটলে এখনও গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। আর এই ইতিহাসের সঙ্গে যে মানুষটার নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি না থাকলে হয়তোবা “সোনার বাংলা” হতো না।  ১৯৪৭-১৯৭১ সালের মধ্যে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। দীর্ঘ ২৪ বছরের বাঙালির আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতি টানার জন্যই ১৯৭১ সালের ৭মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন এবং এই ভাষণ বিশ্ব দরবারে সাড়া ফেলেছিলো প্রবল। এ আহ্বানের  পর থেকেই  মুক্তিযুদ্ধের রণপ্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি আবার শুনেছিলেন, স্বাধীনতার সেই অমোঘ ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছিলো। বন্দীদশায় মৃত্যুভয় থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনি তখনও ছিলেন অকুতোভয় নির্ভীক সৈনিক। ১৯৪৭- থেকে শুরু করে  ১৯৭১ – এ অর্জিত স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ববাংলার মানুষকে অনমনীয় প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে দুরতিক্রম্য লড়াই করতে হয়েছে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি,  সাহিত্য, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে। আর এই সবকিছুর আড়ালে  মূল আহবায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশে  লাল সবুজের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিলো। যুদ্ধের পাঠ চুকিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি  মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশে প্রত্যাবৃত্ত হওয়ার পরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে ধাবিত হয়েছিলেন। দেশের মানুষের প্রতিও তাঁর  ছিলো অঢেল ভালোবাসা  ও বিশ্বাস। তারা কখনও অকৃতজ্ঞ হবে না । তাঁর মহৎ ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাবে না। এই বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে ধানমন্ডির  ৩২ নম্বর সড়কের সাধারণ বাড়িটিতে সপরিবারে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিলেন এবং এই বিশ্বাসই কালসাপ হয়ে ছোবল মেরেছিল জাতীর পিতাকে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি কখনও। সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েকজন  সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ভয়ংকর ঐ অজ্ঞাত দিন হিসেবে তাদের নীল নকশায় ১৫ আগস্ট’কে বেছে নিয়েছিলো। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া স্বাধীনতা উদযাপন ব্যতিব্যস্ত থাকবে সেদিন, এমনটা ভেবেই কি এই দিনের কথা ভাবা হয়েছিলো ?  সবটাই প্রশ্নের সম্মুখে এনে দেয়। ইতিহাসে এ নিয়ে খোলসা করে কোনো আলোচনা নেই। তবে, ইতিহাসের পাতা জানান দেয়, স্বাধীন বাংলাদেশের পেছনে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা । সেই ভয়াল ১৫ আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীরা ছক কষে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিলেন মুজিবর ও তাঁর পরিবারবর্গকে। ইতিহাসে এই নৃশংসতম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সেদিন শুধু মুজিবর নয়, তার সঙ্গে স্বাধীনতার মহত্তম আদর্শগুলোও মৃত বলে ঘোষিত হয়েছিল। সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে  গিয়ে দেশের যে সংবিধান সৃষ্টি হয়েছিলো তাও ভেঙে চুরে দুমড়েমুচড়ে গেছিল সেদিন। ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাবার নয়, মহাকাল মনে রাখবে এই ভয়াল স্মৃতিকে। মননে, চিন্তনে, ভাবনায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চির অমলিন হয়ে রইবে। আজ  ১৫ আগস্ট, ২০২০- এপারে বিজয় কেতন উড়ছে, ওপারে শোকের ছায়া বইছে।

1 thought on “১৫ আগস্ট : কাঁটাতারের এপার ওপার”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *