বাঁশি থেকে বাঁশেরকেল্লা : লোকজীবিকা

কৃত্তিবাসী রামায়ণের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে একটি কথা প্রচলিত আছে, দরিদ্রের পর্ণকুঠির থেকে ধনির রাজপ্রাসাদ সর্বত্রই তার সমান সমাদর। কথাটি বাঁশ প্রসঙ্গেও। প্রচলিত প্রবাদে ‘বাঁশ দেওয়া’ কথাটা বাঁশ সম্পর্কে যতখানি নেতীবাচক দিকের ভাবনা জোগায় বাস্তবে তার অস্তিত্ত্ব সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘বাঁশ দেওয়া’ আর লাঠির মধ্যে খানিকটা আর্তনাদ থাকলেও অন্য সব ক্ষেত্রেই আছে এক জাতীয় প্রাণদ স্বস্তি। ক্ষতিকারক দিক নেই। বাঁশ মহল বা বাঁশ শিল্পের অভ্যন্তরে যদি প্রবেশ করা যায় তাহলে জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় এর উপস্থিতিতে আশ্চর্য হতে হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বত্রই সে তার অস্তিত্ত্বের জানান দিয়েছে। সেখানে প্রয়োজনের ক্ষেত্রটা যেমন রয়েছে, শিল্পের দিকটিও তেমনি। প্রয়োজনের দিকটি লোকায়ত জীবনে আর শিল্পের দিকটি নাগরীক জীবনেই বেশি করে প্রভাব বিস্তার করেছে।

        স্বাভাবিক ভাবেই বাঁশকে কেন্দ্র করে তাই জীবন-জীবিকার কথা এসে পড়ে। লোকজীবিকা প্রসঙ্গে কথাগুলো আসছে। ‘লোকজীবিকা’ বলতে আমরা ধরে নিচ্ছি, আধুনিক টেকনোলজির বাইরে যেসব মানুষ সরাসরি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে নিজে হাতেই প্রয়োজনীয় উপকরণ সামগ্রী তৈরি করে, এবং তা ক্রয়-বিক্রয় করে জীবন নির্বাহ করে।

কোন কিছু থেকে জীবিকা সংস্থানের খবর জানতে হলে তার চাহিদাকে জানতে হয়। প্রয়োজনমূল্যটি যদি না থাকে তবে চাহিদাও থাকতে পারে না। তাই প্রয়োজনের দিকগুলো জানা খুবই জরুরী, তাহলেই বোঝা যাবে বাঁশ লোকজীবন-জীবিকায় কতখানি ভূমিকা পালন করেছে।

        ঘাস পরিবারের বৃহত্তম সদস্য এই বাঁশ কাষ্ঠল চিরহরিৎ উদ্ভিদ। এরা গুচ্ছাকারে জন্মায়। এক এক গুচ্ছে ১০ টি থেকে ৭০/৮০ টি পর্যন্ত গাছ থাকে। মোটামুটিভাবে একটি পরিপক্ক বাঁশ তৈরি হতে দুই তিন বছর সময় লাগে। মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত ইত্যাদি দেশগুলোতে এই উদ্ভিদের বহুলতা লক্ষ্য করা যায়। কমবেশি ২৬ প্রকারের বাঁশ অবিভক্ত বাংলায় দেখা যায়। এর মধ্যে মূলি বাঁশ, মিতিয়া, ছড়ি, তাইক্কা, বাইরা, বাররা, মোকাল, তল্লা, ভেল্ক বাঁশ ইত্যাদি।

তল্লা, বাইরা এবং মূলি বাঁশ দিয়ে শিল্পের কাজকর্ম করা অপেক্ষাকৃত সহজ। প্রক্রিয়াযাত না করলে বাঁশের তৈরি জিনিসগুলোতে দুই তিন বছরের মধ্যে উইপোকা এবং ছত্রাকের আক্রমণ শুরু হয়। তবে বাঁশের কাণ্ড কপার সালফেট, সোডিয়াম কার্বোনাইট এবং বরিক অ্যাসিড (২:২:১ অনুপাতে) দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে নিলে ১৫ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। বাংলার লোকশিল্পীরা এই বাঁশকে প্রকৃয়াজাত করে অথবা না করে তাদের নিপুণ হাতের কারুকার্যে জীবনের সর্বত্র এই বাঁশের প্রয়োগকে সচল করেছেন। যাই হোক প্রয়োজন এবং চাহিদাকে জানতে বাঁশের ব্যবহারকে কতগুলো ক্ষেত্রে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। যথা –

  • গৃহস্থলির কাজে।
  • কৃষিক্ষেত্রে।
  • মৎস ক্ষেত্রে।
  • যুদ্ধক্ষেত্র এবং আত্মরক্ষা।
  • গৃহনির্মাণে।
  • শিল্পক্ষেত্রে।
  • অন্যান্য ক্ষেত্রে।

গৃহস্থলির কাজে :

         চালনি                     খালোই                 ঝুড়ি                    হাত পাখা

লৌকিক সমাজে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে অধিকাংশই প্রকৃতির উপাদান থেকে নির্মিত। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েই তারা তাদের জীবন জীবিকা থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছেন। গৃহস্থলীর কাজকর্ম মেটাতেও তারা প্রকৃতির দারস্থ হয়েছেন দারুণভাবে। সেই প্রয়োজনে বাঁশ ব্যপক ভূমিকা নিয়েছে। যেমন,

কুলো : ধান ওড়ানো, ধানের ময়লা আবর্জনা দূর করা, চাল ঝাড়া, অন্যান্য শষ্যজাতীয় ফসলের আবর্জনা পরিষ্কার করতে একটি প্রয়োজনীয় উপাদান কুলো। বিয়েবাড়িতে বরণডালা সাজানো, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, ছট্‌ পুজো ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কুলো নিত্যপ্রয়োজনীয়। বাঁশকে পাতলা পাতলা করে চিরে প্রথমে মাদুরের মত করে বুনে নেওয়া হয়, তারপর বাঁশের চটা বানিয়ে এর চারপাশ ঘিরে দিয়ে গুণো বা দড়ির সাহায্যে বেঁধে কুলো তৈরি করা হয়।

খালোই : গ্রামে মাছ ধোয়ার জন্য খালোই ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ছোট মাছ যেগুলোর আঁশ বটি দিয়ে ছাড়ানো সম্ভব নয় সেই মাছ গুলো এই খালোইয়ের মধ্যে ফেলে ঝাঁকা দিলে বাঁশের পাতলা করা চটার ধারে আঁশগুলো উঠে যায়। এছাড়া মাছকে ধুয়ে রাখবার পাত্র হিসাবেও এটি ব্যবহার করা হয়, সুবিধা হল এই যে এর গায়ে ফাকা ফাকা অংশ থাকায় সহজেই জল ঝরে যায়।

ঝুড়ি : নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে অন্যতম ঝুড়ি। ঝুড়ির রকমফের আছে। এটি নানা রকমের বুনটের হয়। কম বুনটের ঝুড়ি দিয়ে মাটিকাটা কাজে মাটি বইতে, ধান বইতে, সবজি তুলে আনা-নেওয়াতে ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। ঘন বুনটের ঝুড়ি দিয়ে শস্য জাতীয় ফসল রাখতে এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়, এই ঝুড়িগুলোকে চ্যাঙারীও বলা হয়। আর ছোট একধরনের ঝুড়ি পাওয়া যায় যেগুলোকে চুপড়ি বলা হয়, এগুলো রান্নাবান্না এবং গৃহস্থলীর অন্যান্য খুটিনাটি কাজে ব্যবহৃত হয়।

আংকুরো/হাংকুরো : গ্রামের দিকে অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁস মুরগি পালন করা হয়। বাচ্চা অবস্থার হাঁস মুরগিকে এই হাংকুরো বা আংকুরো দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। এটি দেখতে উলটো ঝুড়ির মত। গম্বুজ আকারের। উপরের দিকে কিছুটা অংশ জুড়ে খোপ খোপ ফাকা রেখে বোনা হয় যাতে বাচ্চাগুলোর অক্সিজেন চলাচলে এবং আলো-বাতাস প্রবেশের কোন অসুবিধা না হয়।

  চালনি : দেশি মুড়ি বা খই ভাজার পর সেগুলোকে চালতে চালনির প্রয়োজন। বালি পাথর চালা চালনি নয়। বাঁশের তৈরি। লোকায়ত মানুষের প্রতিটি ঘরে ঘরে মুড়ি এবং খই ভাজা হয়। সুতারাং চালনি লোক মানুষের একটি খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান।

হাত পাখা : বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদনের বুনিয়াদি তত্ত্ব ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ১৮২০ থেকে ১৮৩০ এর দশকে করেছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে বিদ্যুৎ সর্বত্র প্রবেশ করে নি। বহু গ্রাম আজও ইলেক্ট্রিক বিদ্যুতের সাহায্য ছাড়াই চলছে। সেখানে তাদের একমাত্র ভরসা প্রকৃতি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগে হোক বা পরে মানুষ গরমের হাত থেকে বাঁচতে হাত পাখা ব্যবহার করে আসছে। হাতে যে পাখা চালনা করা হয়, তাই হাত পাখা। এটি তাল পাতা এবং বাশেঁর শলা ও কুঞ্চি দিয়ে তৈরি করা হয়।

ঢাকনা : তরকারি রান্না করে ঢাকা দিতে বা ভাত রান্না করে ঢাকা দিতে বাঁশের তৈরি ঢাকনা গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে ব্যবহার করা হয়।

        এছাড়া মোড়া, ধরা, খাজি, জাগই, গুমাই, চাকী, ধরংগা, পাখীর খাঁচা, রং ডালা, আলু চালা ঝাড়ু চাক ডালা, বানাবানি, চৌকা, পাটি ডালা, মাছ ডালি, পান চালা, কড়পা, তরকারির ঝাকি, ধারাই, গাছের টোপা, ঘুরকি, ডোল, ঘুড়ি, মাদুর ইত্যাদি বাঁশ থেকে নির্মিত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এগুলোর চাহিদা গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক। তবে কিছু কিছু জিনিসের স্থান প্ল্যাস্টিক নির্মিত জিনিস দখল করে নিয়েছে।

কৃষিক্ষেত্র :

কৃষিক্ষেত্রেও বাঁশের নিত্য আনাগোনা। যেমন –

মই/বাশোই : লাঙল দিয়ে চাষ করবার পর জমি অসমতল হয়ে পড়ে। কোথাও মাটি বেশি হয়ে যায় আবার কোথাও কম, কোথাও নীচু আবার কোথাও উচু থাকে। এগুলো ঠিক করতে মই ব্যবহার করা হয়। আবার মাটি গুড়ো করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। একটি বাঁশকে দুভাগে ভাগ করে মাঝখানে ১০ ইঞ্চি মত ফাকা রেখে সমান্তরালভাবে পাতিয়ে বাঁশের চটা বা খুঁটো দিয়ে দুটিকে যুক্ত করা হয়। এটি সিঁড়ি হিসাবেও ব্যবহার করা হয়।

গরুর গাড়ি : যানবাহন হিসাবে একসময় গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু এখন আর তা নয়। তবে এই গরুর গাড়ির ব্যবহার এখন কৃষিক্ষেত্রে হয়। কোন ফসল জমি থেকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় গরুর গাড়ির সাহায্যে। যার প্রায় সবটাই তৈরি করতে বাঁশের দরকার।

টোকা : শঙ্কু আকারের এই টোকা তালপাতা এবং বাঁশের শলা ও চাটা দিয়ে তৈরি করা হয়। কৃষকেরা রোদ এবং বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এটি টুপি হিসাবে ব্যবহার করেন।

 এছাড়া কোদাল, ট্যাঙারি, ফানসে ইত্যদি কৃষিযন্ত্রের হাতল তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার করা হয়। আবার সিম-বরবটি-করলা-লাউ-পটল ইত্যদি লতা জাতীয় গাছের মাচা/হাঙ্‌ তৈরি করা হয় বাঁশ থেকে।

মৎসক্ষেত্র :

নদীমাতৃক বাংলা আর মেছো বাঙ্গালী – দুটি কথাই একথা প্রমাণ করবে মাছ এখানকার জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কখনো খাদ্যের যোগানে কখনো জীবিকার প্রয়োজনে। এই মাছ ধরতে প্রাচীন কাল থেকে লোকায়ত মানুষ যেসব উপকরণ ব্যবহার করেন তার অধিকাংশই বাঁশ থেকে নির্মিত। যেমন –

মাছ ধরার চাই : বাঁশকে চিরে চিরে শলা বানানো হয়, এরপর তালপাতার ডগা ভিজিয়ে রেখে তা থেকে দড়ি তৈরি করা হয়। এই শলাগুলোকে তালপাতার ডগা থেকে নির্মিত দড়ি দিয়ে আয়তক্ষেত্র আকারে বাঁধা হয়। একপাশে বা দুপাশে মুখ রাখা হয় মাছ ঢোকার জন্য। মুখটি এমন ভাবে নির্মাণ করা হয় যাতে কোন মাছ ধুকতে পারবে কিন্তু বেরোতে পারবে না। নির্মাণের আকার বিভিন্ন হতে পারে। দুটি জলাশয়ের সঙ্গম স্থলে যেখান দিয়ে জল যাতায়াত করে এবং একটু স্রোত থাকে সেখানে এগুলো পাতা হয়। পুটি, শোল, চ্যাঙ, খলসে, তেলাপোয়া ইত্যাদি ছোট মাছ এতে ধরা পড়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।